বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয়ের আগের দিন অর্থাৎ গত ৪ আগষ্ট দুপুরের কিছু পর ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কে নষ্ট করার জন্য প্রশাসনের এক গাড়ি অতি দ্রুত গতিতে ছাত্রদের মিছিলের উপর দিয়ে চালিয়ে দেয়। সেই গাড়ির চাপায় সেখানেই শহীদ হন মাহবুব আলম(২০) নামে আইটি উদ্যোক্তা সহ আরও অনেকেই । আর সেই সাথে নিমিষেই শেষ হয়ে যায় শহীদ মাহবুবের পরিবারের সকল স্বপ্ন।
শহীদ মাহবুবের বাবা মিরাজ আলী দীর্ঘ ১৭ থেকে ১৮ বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন। তার বাবা এখনো বলতে পারে না তার আদরের সন্তান দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়েছে। তাঁর মা মাহফুজা বেগম গৃহিণী। পাকুড়িয়া ইউনিয়নের চৈতনখিলা বটতলা গ্রামে ৮ শতক জমির বসতভিটা ছাড়া মাহবুবের বাবার কোনো ফসলি জমি নেই। তাই মাহবুবকে নিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আন্দোলনে নিহত হয়ে স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।
তার মা কান্না জড়িত কন্ঠে জানান, ‘আমার ছেলে মাহবুবের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া কইরা বড় আইটি উদ্যোক্তা হইব। সংসারের অভাব-অনটন দূর করব। কিন্তু ওর স্বপ্ন আর পূরণ হইল না। আমি ছেলে, আন্দোলন করতে গিয়া প্রশাসনের গাড়ির তলে পইড়া ও মইরা গেল। আর আমার ছেলের স্বপ্ন রাজপথে মিশে গেল। যারা আমার ছেলেরে মারছে, আমি তাদের বিচার ও শাস্তি চাই।’
শহীদ মাহবুব আলম (২০) সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়নের চৈতনখিলা বটতলা গ্রামের মো. মিরাজ আলীর ছেলে। তিনি শেরপুর সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিষয়ের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। আইটি ল্যাব এডুকেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি।
গত ৪ আগস্ট বিকেলে শেরপুর শহরের খরমপুর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুতগতির গাড়ির চাপায় মাহবুব আলম শহীদ হন। ওই দিন গাড়ি চাপা ও প্রশাসনের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আরও পাঁচজন শহীদ হন আহত হয় অনেকেই ।
নিহত অন্য চারজন হলেন, শেরপুর শহরের বাগরাকসা এলাকার বাসিন্দা ও আহ্ছানউল্লা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তুষার আহমেদ, ঝিনাইগাতী উপজেলার পাইকুড়া গ্রামের শারদুল আশিস, শ্রীবরদী উপজেলার রূপারপাড়া গ্রামের সবুজ হাসান ও সদর উপজেলার ভীমগঞ্জ এলাকার মীম আক্তার। তাঁরা শিক্ষার্থী ছিলেন।
মাহবুব আলমের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, চৈতনখিলা বটতলা গ্রামের দরিদ্র মিরাজ আলীর দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে মাহবুব ছিলেন চতুর্থ। মাহবুবের বড় দুই বোন মিলিনা ও সেলিনার বিয়ে হয়েছে। বড় ভাই মাজহারুল ইসলাম শেরপুর সরকারি কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। আর ছোট বোন মারিয়া চলতি বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। ছোটবেলা থেকেই মাহবুবের তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি আকর্ষণ ছিল। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ালেখা করার সময় প্রতিষ্ঠা করেন আইটি ল্যাব নামের কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার।
অর্থাভাবে কাঁচা ভিটির ওপর নির্মিত মাহবুবদের টিনের বসত ও রান্নাঘরটি জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। নতুন একটি ঘর তৈরি করার জন্য মাহবুব কয়েক দিন আগে হাজারখানেক ইট কিনেছিলেন। সেগুলো বাড়ির ভেতরে জড়ো করে রাখা হয়েছে।
মাহফুজা খাতুন বলেন, মাহবুব মানুষকে কম্পিউটারের বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং দিয়ে যে টাকা আয় করত, তা নিজের পড়ালেখা ও সংসারের খরচ মেটাত। সংসারের অন্যতম উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তাঁর পরিবারে নেমে এসেছে অন্ধকার। মানসিক ভারসাম্যহীন স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে এখন কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। এক কথায় তাঁর অকালমৃত্যুতে পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়েছে।
এফ এম সিফাত হাসান, শেরপুর প্রতিনিধি