দিমা নেফারতিতি
নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগে জামিল আল তাহেরি ঢুকেছিলেন সতের বছর আগে। তিনি একজন ইয়েমেনীয় মুসলমান। সাফল্যের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ তিনি নিউইয়র্কের পুলিশ বিভাগ অর্থাৎ এনওয়াইপিডির টপ র্যাংকিং কমান্ডিং অফিসার। মানুষ যে তার স্বপ্নের চেয়েও বড়, সেই সত্যটি আবারো প্রমাণিত হয়, জামিল আল তাহেরিকে জানলে। খুব ছোট বেলা থেকেই তাহেরির স্বপ্ন ছিল পুলিশ অফিসার হবার। কিন্তু একদিন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পুলিশ বিভাগের টপ র্যাংকিং অফিসার হবেন তিনি, স্বয়ং জামিল আল তাহেরির কাছেও তা ছিল কল্পনাতীত। ৯/১১ এ পরিবর্তিত আমেরিকায়, একজন মুসলিম পুলিশ অফিসার হিসেবে এই উচ্চতায় পৌছানোটাও ছিল অনেক চ্যালেঞ্জিং।
তিন বছর বয়সে বাবা-মার সাথে ইয়েমেন থেকে আমেরিকায় আসেন তাহেরি। তার মধ্যবিত্ত মুসলিম বাবা-মা, সারাজীবন তাকে সবচেয়ে বেশি যা শিখিয়েছেন, তা হল প্রগাঢ় মূল্যবোধ নিয়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। দু’মাস আগে ১১৫ প্রিসিংক্টের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেছেন তাহেরি। জ্যাকসন হাইটস এবং এর আশপাশের এলাকা তার বর্তমান কর্মক্ষেত্র।
সম্প্রতি সাপ্তাহিক আজকাল অফিসে এ প্রতিবেদকের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে জামিল আল তাহেরি জানিয়েছেন তার সাফল্যের গল্প এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা।
দিমা নেফারতিতি: আমেরিকায় আপনার শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতা এবং নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সদস্য হবার গল্পটা বলুন।
জামিল আল তাহেরি: খুব অল্প বয়স থেকেই আমার দেখা পুলিশ সদস্যরা আমাকে অনুপ্রাণিত করতেন। সেই সাথে ছোটবেলা থেকেই নেতৃত্ব দেওয়ার একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল আমার। স্কুলে বিভিন্ন সমস্যায় ক্যাপ্টেন এর ভূমিকা পালন করতাম আমি। মসজিদে ইমামতি করবার অভিজ্ঞাও আছে। একুশ বছর বয়সে পুলিশ একাডেমীতে যোগ দেই। পাশাপাশি বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন এবং ফিনান্সে ব্যাচেলর করি, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করি সিটন হল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, একাউন্টিংয়ে ডিগ্রি অর্জন করি ব্রুকলিন কলেজ থেকে। তারপর পুলিসিং এর উপরে গ্রাজুয়েট সার্টিফিকেশন অর্জন করি জন জে কলেজ অব ক্রিমিনাল জাস্টিস থেকে, ক্রিমিনাল জাস্টিসের উপরে সার্টিফিকেশন অব এচিভমেন্ট অর্জন করি ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ভার্জিনিয়ার এফবিআই ন্যাশনাল একাডেমী থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করি। প্রথম মুসলিম অফিসার হিসেবে আমি এফবিআই একাডেমীতে যাবার জন্য মনোনীত হয়েছিলাম। সতের বছর আগে, নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে খুব অল্প কজন মুসলিম অফিসার ছিলেন। এখন সংখ্যাটা অনেক বেড়েছে।
দিমা নেফারতিতি: আমেরিকায় আরব ইমিগ্রান্টরা মূলত ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। কিন্তু আপনি নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে চেয়েছেন কেন?
জামিল আল তাহেরি: আমার চাচা এবং কাজিনদের অনেকেই ইয়েমেনে আর্মি এবং পুলিশে কাজ করে। সেটাও একটা অনুপ্রেরণা ছিল। এছাড়া আমি কঠোর পরিশ্রম করতে ভালোবাসি। পুলিশ ফোর্স পরিশ্রমী মানুষদের জন্য আদর্শ জায়গা। এটি এমন একটি কর্মক্ষেত্র যেখানে ২৪ ঘন্টাই নিজের স্নায়ুকে সজাগ রাখতে হয়।
দিমা নেফারতিতি: একজন মুসলিম পুলিশ অফিসার হিসেবে আপনি কি কোন বৈষম্যের শিকার হয়েছেন? মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি আমেরিকানদের মনোভাব কেমন?
জামিল আল তাহেরি: নাইন ইলেভেনের পরে মুসলিমদের সম্পর্কে আমেরিকানদের নেতিবাচক ধারণা ছিল। কিন্তু সেই পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। এখন সময় এসেছে মুসলিমদের প্রতি সমগ্র জাতির ইতিবাচক ধারণাকে আরো সুসংহত করার। মুসলিমদের প্রতি হাল্কা কিছু বৈষম্য এখনো হয়ত আছে বা থাকবে। কিন্তু তা আগের মত নয়। আমেরিকায় মুসলিম ইমিগ্রান্টদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এবং তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতা এবং কাজ দিয়ে সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম আমাদের বিনয় এবং সহিষ্ণুতা শেখায়। তাই প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার প্রয়োগ ঘটিয়ে আমাদের ইমেজকে উন্নত করতে হবে। আমাদের দায়িত্ব হল ভালো কাজ এবং ভালো আচরণের মধ্যে দিয়ে মুসলমানদের ইতিবাচক দিক প্রমাণ করা। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং পারস্পরিক সৌহার্দ্যের বন্ধনকে মজবুত করা। পরিস্থিতি বদলেছে বলেই নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের মত বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে একজন মুসলিম অফিসার হিসেবে আমি কমান্ডিং অফিসার হয়েছি। এটাইতা ইতিবাচকতার প্রমাণ। এমন দৃষ্টান্ত আরো প্রসারিত করতে হবে।
দিমা নেফারতিতি: আমেরিকার পুলিশ ফোর্সের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম অফিসার হিসেবে, মুসলিমদের ইতিবাচক ইমেজ বৃদ্ধিতে আপনি কি করছেন?
জামিল আল তাহেরি: একজন মুসলিম পুলিশ অফিসার হিসেবে, আমি দূরত্ব ঘুচিয়ে পারস্পরিক বন্ধনকে প্রগাঢ়় করার পরামর্শ দেই। আমেরিকার অনেক শহরে ঘুরেছি আমি। একই সাথে মসজিদ, মন্দির, চার্চ পরিদর্শন করেছি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সৌহার্দ্যের ভিতর দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে যাচ্ছি। আমেরিকা এমন একটি দেশ, যেখানে সব ধর্ম, সব জাতির বাস। আমাদের কর্তব্য হল প্রত্যেকের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেই সাথে আমাদের দায়িত্ব প্রতিটি ইমিগ্রান্ট কমিউনিটিকে তাদের অধিকার এবং সার্বজনীন আইন সম্পর্কে শিক্ষিত এবং সচেতন করা এবং পুলিশ যে সর্বসাধারণের বন্ধু, সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করা। দিমা নেফারতিতি: আমেরিকায় মুসলিম কমিউনিটির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি?
জামিল আল তাহেরি: সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের নিজেদের মধ্যে। ভালোবাসা দিয়ে নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, ঘৃণার দেয়াল দূর করে, সহমর্মিতার সেতু বন্ধন জোরালো করতে হবে। নিজের আইডেন্টিটি নিয়ে মর্যাদা অনুভব করতে হবে, হীনমন্যতায় নয়। একজন মুসলিম হিসেবে নিজেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কেউ না ভেবে, এই দেশ, এই সমাজের একজন ভাবতে হবে, সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
দিমা নেফারতিতি: ১১৫ প্রিসিংক্ট তথা জ্যাকসন হাইটস এলাকায় কাজ করতে কেমন লাগছে?
জামিল আল তাহেরি: আমি গর্বিত এমন একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকায় দায়িত্ব পেয়ে। এখানকার ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এবং কমিউনিটি নেতাদের সাথে পরিচিত হয়ে আমি আনন্দিত। মিশ্র সংস্কৃতির একটি আদর্শ জায়গা এটি। এই এলাকার সর্বসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
দিমা নেফারতিতি: পুলিশ বিভাগের অর্থায়ন বা বাজেট নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
জামিল আল তাহেরি: একথা সত্যি, বাজেটের ক্ষেত্রে নানা রকম সীমাবদ্ধতা থাকে। তবে আমার অবস্থান থেকে আমি জননিরাপত্তার স্বার্থে আরো বেশী অর্থ বরাদ্দের জন্য সুপারিশ করব।
দিমা নেফারতিতি: দীর্ঘ কর্মজীবনের মজার ২/১টি ঘটনা বলুন।
জামিল আল তাহেরি: ভালো-মন্দ মেশানো সতের বছরের এই কর্মজীবনের অজ¯্র গল্প রয়েছে। শারীরিকভাবেও অনেকবার আহত হয়েছি। আজকালের পাঠকদের জন্য একটা মজার গল্প বলি। মাঠে-ঘাটে দায়িত্ব পালনকালে অন্য ধর্মের অনেকেই আমাকে বলেছে, একজন মুসলিম হিসেবে তুমি এত ঠান্ডা প্রকৃতির অধিকারী কেমন করে হলে। আমি হেসে বলেছি, ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম শান্ত হতে শেখায়। একজন সত্যিকারের মুসলমান সবসময় শান্ত এবং ধৈর্য্যশীল থাকেন। আমি যেমন একজন মুসলিম তেমনি আমি একজন ইন্টারফেইথ মানুষ। সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
দিমা নেফারতিতি: আজকালকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
জামিল আল তাহেরি: বাংলাদেশিরা নিউইয়র্কে খুব ভাল করছে। সর্বত্র তারা প্রতিভার সাক্ষর রাখছে। আমি বাংলাদেশিদের ধন্যবাদ জানাই। আজকালকেও ধন্যবাদ জানাই।
Comments: